আমার জীবনের প্রথম এডভেঞ্চার :
আজ সরস্বতীপূজো। আজকের দিনেই আমাদের সবারই বোধহয় হাতেখড়ি হয়। স্লেট পেনসিলে মাতৃভাষা লিখনের প্রথম শিক্ষা। তাই, সৌমিত্রর আবেদনে সাড়া দিয়ে আজকের দিনটিই বেছে নিলাম আমার জীবনের প্রথম এডভেঞ্চার-এর স্মৃতি রোমন্থনের জন্য।
সেটা ছিল ১৯৭৪ সালের জানুয়ারির প্রথমভাগ। বাবা কয়েক দিন আগেই অফিস থেকে ফিরে খবর দিলেন যে আমরা সুন্দরবন বেড়াতে যাবো। ওঃ, কি মজা। ওঃ।
নিদিষ্ট দিনে চ্যাটার্জি পরিবারের পাঁচ সদস্য বেরিয়ে পড়লাম, ক্যানিং এর উদ্দেশ্যে। সেখান থেকে লঞ্চে বাসন্তি। এক রাত বাবার এক বন্ধুর বাড়িতে কাটিয়ে পরদিন সন্ধ্যে আটটা নাগাদ হাতে টানা নৌকায় উঠলাম, নৌকা ভাসলো মাতলার বুকে।
আমার অবস্থা তখন সাংঘাতিক। আবেগে, উত্তেজনায় আমি তো দিশেহারা। এই শীতে সারারাত নৌকার মধ্যে? বাপ্ রে!!!
চারজন লোক এসে নৌকায় উঠল। তারা-ই মাঝি। নিজেদের মধ্যে নানারকম আলোচনা করছে তারা। আমি শুধু ভাবছি সারারাত এই নৌকায় থাকব কী করে? ধীরে ধীরে নৌকা একবার দুলে উঠেই চলতে শুরু করলো। চারিদিকে অন্ধকার। কিছুই দেখা যাচ্ছে না। একটা অদ্ভুত পরিবেশে ছলাত্ ছলাত্ শব্দ করে নৌকা এগিয়ে যাচ্ছে। আমরাও চুপ। মনে মনে ভয় লাগছে, শুধু বাঘের বিরাট মুখটা মনে পড়ছে।
হঠাৎ আমার দুবছরের বড় দাদা বাবার কাছে এসে বলল যে, মাঝিদের কথা ভালো লাগছেনা, ওরা যদি আমাদের বিপদে ফেলে"?
আমার তো কাঁদো কাঁদো অবস্থা। আমার ছোট ভাই আমাকে কানে কানে বলল,"ভয় কী দিদিভাই, আমি তো আছি "। ওর কথাতেই আমার যেন ধড়ে প্রাণ এল। মাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়লাম।
ঘুম ভাঙলো পরদিন সকালে।
কি মিষ্টি রোদ, আর ঠান্ডা হাওয়ায় মনটা জুড়িয়ে গেলো। নৌকা নদীর পাড়ে এসে দাঁড়াতে আমরা কিছু শুকনো খাবার খেয়ে তীরে নামলাম। জায়গাটার নাম সজনেখালি। তখন মনে ভরপুর আনন্দ আর আনন্দ।
মাঝিরা বারবার সাবধান করে দিল যে আমরা যেন জঙ্গলের বেশি গভীরে না যাই। দু ঘন্টার মধ্যে যেন ফিরে আসি।
রাজা, তাঁর রানী আর দুই রাজপুত্র আর এক রাজকন্যাকে সঙ্গে নিয়ে প্রবেশ করলেন রয়াল বেঙ্গল টাইগারের সাম্রাজ্যে। চারপাশে ঘন সবুজ বন, উঁচু উঁচু গাছ আর কত কত পাখির কত রকম কলকলানি। অদ্ভুত একটা শান্তি চারদিকে। বাবা আমাদের বলছিলেন বাঘ কীভাবে শিকার ধরে। জানলাম বাঘ দলের মধ্যে একজনকে শিকার হিসেবে বেছে নিয়ে চুপিচুপি তাকে অনুসরণ করে পিছন থেকে এক লাফ দিয়ে তার ঘাড় কামড়ে তাকে অন্য জায়গায় টেনে নিয়ে যায়।
আমার আবার বুক ভয়ে কেঁপে উঠলো। সামনে এক পা যাচ্ছি আর পেছনে তাকে খুঁজছি।
হঠাৎ বাবা চেঁচিয়ে উঠলেন, "ওই দেখ!" বাবার দৃষ্টি অনুসরণ করে দেখি বাঘের পায়ের ছাপ। টাটকা। ভোরবেলাতে এখানে ঢুকে নরম মাটিতে পায়ের ছাপখানি রেখে গেছে যেন আমাদেরই জন্য। বাবা ওই মাটির ছাপ হাতে তুলে নিলেন স্মৃতি হিসেবে। নৌকার গলুইতে সারাদিন রোদে শুকিয়ে সে'টি দিব্যি বহনযোগ্য হ'য়ে গেল। বহুদিন আমাদের বাড়িতে ছিল সে মাটির ঢেলা। কত লোক যে দেখতে আসত!
ধীরে ধীরে ফিরতে লাগলাম এবার নৌকার দিকে। দেরী হয়েছিল আসতে, মাঝিরা একটু চিন্তা করছিল। ওরা নৌকায় রান্না করেছিল আলু, ডিম সেদ্ধ দিয়ে ভাত।
আবার নৌকা রওনা দিল বাসন্তির উদ্দেশ্যে। হঠাৎ মাঝিদের নেতা সাগর (নামটা আজো মনে আছে) জলে নেমে পাড়ে উঠে একটা গাছে উঠল। তারপর ফুলপাতা দিয়ে বিড়বিড় করে কিসব বলে আবার জলে নেমে সাঁতরে এসে নৌকায় উঠে সকলের শরীরে ছুঁয়ে দিল ঐ লতাপাতা। জানলাম, ও একজন গুনিন, তাই নৌকাকে সুরক্ষার জন্য এই ব্যবস্থা নিলো।
আর কি? ছোট্ট মিষ্টি একটা পারিবারিক 'অভিযান'শেষ হল। আজ ভাবি, জীবনে অনেক বেড়িয়েছি কিন্তু ১৪বছর বয়সে পরিবারের সঙ্গে এমন একটা রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা লাভ করার সুযোগ পেয়ে আমি ধন্য। এখন তো সুন্দরবন যাওয়া মানে পাশের পাড়ায় যাওয়া। কিন্তু আমাদের মত সারারাত মাতলা নদী তে দাঁড়টানা নৌকায় ভাসতে কতজন পেরেছে???
Oshadharon obhigwota share korlam ma'am. Darun laglo pore.
ReplyDeleteঅসাধারণ একটি ভ্রমণ কাহিনী। লেখার মুন্সীয়ানায় হয়ে উঠেছে জীবন্ত।
ReplyDeleteসুন্দর লেখার কারুকার্য। অসাধারণ বলার ধরন আর আ লিখুন।
ReplyDeleteবরুণ ব্যানার্জি
Khub sundor didi....pore mon ta bhore gelo❤❤
ReplyDeleteAsadharon lekhoni....pore bhison valo laglo didi..mone dhore jawar motoe lekha
ReplyDelete..Anushka
অপূর্ব, আপনি এইভাবে আরো লিখে যান
ReplyDeleteমনে হচ্ছিল যেন ঐ সফরে আমি সঙ্গী ছিলাম। যে লেখক পাঠক কে গল্পের মধ্যে সম্পৃক্ত করতে পারেন তিনি ই কথা শিল্পী। আরো গল্প শোনার জন্য উদগ্রীব ।
ReplyDeleteবরুণ ব্যানার্জি
Khub sundor likhechen didi, pore sotti khub valo laglo. Ak kothay....AWESOME!!!
ReplyDeleteKhub sundor hoeche lekhata.Asha rakhi aei rokom lekha amra r o pabo.
ReplyDeleteখুব ভালো লাগল পড়ে, দারুণ হয়েছে লেখাটা, আরো আরো লেখা চাই । এতো গল্প না, শব্দের আয়েনাতে জীবনের প্রতিছবি।
ReplyDeleteঅর্পিতা নাহা ঘোষ
Deleteদারুণ experience share করেছো।লেখার সাবলীলতা ও বাধুনি খুব সুন্দর তুমি এগিয়ে চলো।
ReplyDelete