Skip to main content

অলক কুমার গাঙ্গুলী

খাজিয়ার থেকে মণিমহেশ : এক তারুণ্যভরা সৌন্দর্য্য।

মাঝেমধ্যে আকস্মিকভাবে বিনা চেষ্টায় আমার সময়-পর্যটনের (time travel এর) সুযোগ ঘটে। যেসব মাধ্যম সময় যন্ত্রের (time machine-এর)কাজ করে সেগুলো বেশ মজার। হয়ত কোন জায়গার ছবি বা কুড়োন কোন পাথরখন্ড না হয় কোন লেখার পাতা। গত সপ্তাহের কথা বলি, কিছু দরকারী কাগজ খুঁজতে গিয়ে অন্য একটা বিচ্ছিন্ন পাতা নজরে এল। কাজের কিনা বুঝতে সবে দুলাইনে চোখ বুলিয়েছি অমনি দেখি আমি আর পড়ার ঘরে নেই; পৌঁছে গেছি ২৫বছর আগের দেখা হিমাচলের খাজিয়ারে। এরপর চোখের সামনে কত ছবি, কত সুখশ্মৃতির আনাগোনা। তারপর হঠাৎ কারো ডাকে বাস্তবে ফিরে আসা। সময় বিশেষে এরকমই সব ভ্রমণ হয় যাতে আমার ভূমিকা আছে, নিয়ন্ত্রণ নেই।
এক পাতার ছোট্ট লেখা---খাজিয়ারের প্রাঙ্গণে কিছু সময় বিশ্রাম নিয়েছিলাম, এটা সেই সময়ের কল্পনা। ঐ ভ্রমণের কিছু ছবি ছিল, লেখা কিছু ছিল না। এতদিন পরে এটা পাওয়ার পর ঐ যাত্রার মূল আকর্ষণ কেন্দ্রগুলো সম্বন্ধে কিছু লিখে রাখার ইচ্ছায় এই প্রয়াস। এখন তো বেড়ানো বন্ধ হয়ে গেছে, আর লিখতেও আসুবিধা হয়--তাই ফোনের পাতায় লেখার চেষ্টা করে দেখছি, পারি কিনা। বাংলায় লেখার অভ্যাস নেই, খালি হোঁচট খাচ্ছি আর বানানের কথা কি বলি দফারফা করে ছাড়ছি। ভুল করেও আর লিখবো না।

সেবার ছুটিতে (জুন ১৯৯৩) অমিত আর আমি হিমাচলের মণিমহেশ শৃঙ্গ দেখতে বেড়িয়েছিলাম। ট্রেনে চাক্বিব্যাঙ্ক, পরে গাড়িতে ডালহৌসি, খাজিয়ার, চাম্বা, ভারমোর, হাডসার হয়ে ১৩/১৪ কিমি হেঁটে মণিমহেশ পৌঁছই। এই লেখা শুধুমাত্র খাজিয়ার আর মণিমহেশ নিয়ে কারণ ওদের সৌন্দর্যই আমাকে বেশি আকর্ষণ করেছিল। অন্য কেন্দ্রগুলোও নিঃসন্দেহে সুন্দর তবে সবার সম্বন্ধে লিখতে গেলে ইতিহাস হয়ে যাবে। অল্পতেই তুষ্ট হওয়া ভালো।

খাজিয়ার/খাজ্জিয়ার

হিমাচলের পশ্চিম-মধ্য প্রান্তে ডালহৌসি থেকে চাম্বাগামী বাস রাস্তার প্রায় মাঝামাঝি খাজিয়ারের অবস্থান। ধওলাধর শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত এই প্রায় গোলাকার উপত্যকা তিনদিকে পাহাড় ঘেরা। দেখতে অনেকটা চ্যাপ্টা কড়াইয়ের মতো। মাঝখান থেকে চারপাশ খুব মৃদু ঢালে ক্রমোচ্চ হয়ে পাহাড়ে মিশেছে। মধ্যে একটা ছোট হ্রদ, তার মধ্যে আরও ছোট একটা দ্বীপ যা শৈবালদামে সৃষ্ট। একটা পার্বত্যনালা হ্রদটাকে পুষ্ট করেছে। বর্ষাকালে হ্রদের ব্যাপ্তি ও গভীরতা কিছুটা বাড়ে। হ্রদের চারপাশ নরম সবুজ ঘাসের কার্পেটে মোড়া। প্রায় ৬,৩০০ ফুট ওপরে অবস্থান করায় খাজিয়ারের আবহাওয়া শীতকাল বাদে মনোরম। শীতে ঠান্ডা ভালই। উপত্যকার একপাশে দ্বাদশ শতাব্দীতে নির্মিত খাজ্জিনাগের মন্দির। ভেতরে কাঠের কাজের অলংকরণ আর কিছু সাপের মূর্তি রয়েছে। উপত্যকার পশ্চিমে কালামুনি-খাজিয়ার বন্যপ্রাণ অভয়ারণ্য, হরিণ ও ভাল্লুকের বিশেষ আবাসস্থল। ঘন নাতিশীতোষ্ণ অরণ্যে ঢাকা প্রান্তভাগের পাহাড়গুলো যেন ধাপে ধাপে ওপর উঠে গেছে। আর কি অপূর্ব সবুজ পাইন,সিডার,ফার, দেওদারের ঘন চাদরে ঢাকা যে চোখ ফেরানো দায়।
খাজিয়ারের পান্না-সবুজ তৃণভূমিতে হাঁটুন, দৌড়ন, ঘোড়ায় চড়ুন কি গড়াগড়ি খান, সবই অত্যন্ত আনন্দের; কিন্তু সংযতভাবে। অসংযত কোলাহলমুখর উৎশৃ়ঙ্খল জনতার ভিড়ে খাজিয়ারের সুষমা শুধু মলিনই হয়। নির্জনে শান্ত হয়ে বসলে তার অনাবিল স্নিগ্ধরূপ অনুভব করা যায়। ওর তারুণ্যভরা সৌন্দর্য লিখে বোঝানোর নয়। ১৯৯২ সালে সুইজারল্যান্ডের ভারতস্থ Head of Chancery & Vice Counselor, Mr. W. T. Blazer খাজিয়ার দেখে তাকে ভারতের সুইজারল্যান্ড বিশেষণে ভূষিত করেছেন। এর এগারো মাস পর নিরিবিলিতে আমার খাজিয়ার দর্শন। মনে হয়েছিল এরকম রোমান্টিক স্পটতো আগে দেখিনি। ভয় হয় গত ২৫ বছরে এরকম সুগম পর্যটন কেন্দ্রে অশিষ্ট পর্যটকদের লাগামছাড়া ভিড়ের পরিনাম কি হতে পারে। খাজিয়ার এখনো সেরকম মুগ্ধকরা তারুণ্যে ভরপুর আছে কি না।

খাজিয়ার প্রসঙ্গ শেষ করি পুরোনো সেই কাগজটার কথা বলে। ফিরে আসার বেশ কিছু দিন পরে এক অলস সায়াহ্নে হঠাৎ করেই খাজিয়ারের কথা মনে পড়ায় এই কাল্পনিক রোমন্থন।। তুলে দিলাম, ভালো লাগতে নাও পারে।

কল্পলোকের কন্যা--খাজিয়ার

খাজিয়ারের কথা কি কখনো তোমায় বলেছি? হয়তো না। ও এমন এক তরুণী যে মর্তভূমিতে বাস করলেও অমরার কন্যা। অসাধারণ দেখতে। তুমি না দেখলে বুঝবে না ওর রূপ কত সজীব, সরল আর নরম সৌন্দর্যে ভরা। ও থাকে হিমাচলের ডালহৌসি থেকে ২৩/২৪ কিমি দূরে। পারলে দেখা করে এসো; নিশ্চয়ই আমার মতো ওর টানে পড়ে আবার ফিরে যেতে চাইবে।

চারপাশে সিডার, পাইন, দেওদারের ঘন সমারোহে মোড়া সবুজ পাহাড়গুলো থাকে থাকে ওপরে উঠে গেছে। মাঝখানে সবুজ ঘাসের ঢালু প্রান্তর; আর তার মধ্যে খুব ছোট্ট একটা হ্রদ। এসব কিছুই তোমার-আমার বাড়ি থেকে প্রায় ৬৫০০ ফুট ওপরে, কিন্তু তোমার কোন কষ্ট হবে না। সকাল বা দুপুরের নরম রোদ মেখে গায়ে একটা হাল্কা শাল জড়িয়ে পাইনের বনে কিম্বা ঘাসের খোলা মাঠে যখন অলস পায়ে এগোবে তখন অনুভব করতে চেষ্টা কোরো খাজিয়ারের তারুণ্য ভরা রূপকে। ও কথা বলে দেবদারু বনে বয়ে যাওয়া বাতাসের মর্মর ধ্বনিতে, পাখীর কুজনে বা ঝর্ণার কলতানে। ও তোমাকে ঘিরেই থাকবে অথচ ধরতে চাইলে ধরা দেবে না।

খাজিয়ারের উঠোনে পায়চারি করছিলাম, এক সময় বিশ্রাম নিতে সিডার গাছের নিচে নরম ঘাসের কার্পেটে শুয়ে কখন যে ওর স্পর্শ পেয়ে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলাম জানি না। চোখ বুজে ওর প্রকৃত রূপ দেখতে পেলাম। কি স্নিগ্ধ আর অনাবিল সে রূপ। তন্দ্রার আবেশ কাটার মুখে দেখি অপরূপা খাজিয়ার চারপাশের সবকিছুর মধ্যে নিজের সত্তাকে মিলিয়ে দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। সেই থেকে আমি খাজিয়ারের প্রেমে মজে আছি।

খুব ইচ্ছে হয় তোমায় নিয়ে ওর কাছে যাই। খাজিয়ার ওর ঘর সাজিয়েছে এমন রোমান্টিক করে যে মুখের কথায় বোঝান যাবে না। আর চাঁদনি রাতে ওর বাড়িতে থাকলে তুমি নির্ঘাত চন্দ্রাহত হবে। কল্পনায় হলেও তোমায় নিয়ে যেতে চাই কারণ খাজিয়ারের উঠোন প্রেমের শেষ কথা বলার সবচেয়ে উপযুক্ত স্থান। চাঁদনি রাতে সেখানে তোমাদের পাশাপাশি বসাব। তুমি প্রগলভা, আর খাজিয়ার মুখে কিছুই বলে না। মাঝে বসে অনুভব করতে চাই কাকে মন দেব, তোমাকে না ওকে।

খাজিয়ার থেকে চাম্বা ২৩/২৪ কিমি, আর চাম্বা থেকে ভারমোর প্রায় ৬৫ কিমি। ভারমোর থেকে হাডসার প্রায় ১১ কিমি। আগে হাঁটতে হত; পরে গাড়িতে যাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে। প্রকৃত অর্থে হাডসার থেকেই মণিমহেশের ট্রেকিং শুরু হয়। হাডসার প্রায় ৭০০০ ফুট আর মণিমহেশ ১৩৫০০ ফুট। দূরত্ব ১৩/১৪ কিমি। একটা পার্বত্য উপত্যকা যার ঊর্দ্ধভাগে মণিমহেশের পাদদেশ অঞ্চল থেকে প্রথমে কিছু ছোট পার্বত্য নদী যার মধ্যে মণিমহেশ গঙ্গা সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য প্রবাহিত হয়েছে। কিছুটা নামার পর ধানছোর কাছ থেকে ধানছো নালা নামে নিম্নে প্রবাহিত হয়ে হাডসারের কাছে বুধিল বা বুধাল/ বুড্ডাল নদীতে মিশেছে।

প্রথম দিন ভারমোর থেকে ধানছো (৯৫০০ ফুট) প্রায় ১৮ (১১+৭) কিমি পথ পাড়ি দিয়ে ধানছোতে রাত কাটিয়ে পরের দিন সকালে মণিমহেশ যাত্রা। ধানছো থেকে চড়াই পথ অপেক্ষাকৃত বেশি। ৬.৫ কিমি পথে ৪৫০০ ফুট মতো। সকাল ৭টায় বেড়িয়ে ১০ নাগাদ মণিমহেশ ক্ষেত্রে পৌঁছই। মাঝপথে ছোট একটা চায়ের দোকানে আধঘন্টার বিরতি। ঐক্ষেত্রে ২ ঘন্টা মতো ছিলাম; শুধুমাত্র আমরা দুজন। মন-প্রাণ ভরে গেছিল।

হিমাচলে মণিমহেশ চাম্বাকৈলাশ নামে অভিহিত হয়ে থাকে। অবস্থানগত ভাবে এই শৃঙ্গ অবহিমালয়ের পীরপঞ্জাল (মতান্তরে ধওলাধর) শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। উচ্চতায় ১৮,৫৪৭ ফুট, ত্রিভুজাকৃতি, নয়নাভিরাম কৈলাশপতি গলায় দৃষ্টিনন্দন শ্বেতশুভ্র উপবীতের ন্যায় একটা হিমবাহ ধারণ করে আছেন। আর পাদদেশ মনোরম সরোবর শোভিত। কৈলাশপতির জটার মতো একাধিক ছোট নদী সৃষ্টি হয়ে শোভা বর্ধন করেছে। প্রায় ১৩,৫০০উচ্চতায় থাকা মণিমহেশ কুন্ড বা সরোবর মহেশ্বর-পার্বতীর অবগাহন স্থল। মহেশের পাশে তার সঙ্গী হিসেবে আরও কিছু হিমবাহ বেষ্টিত পাহাড়-পর্বত অবস্থান করছে। রৌদ্রকরোজ্জ্বল নির্মেঘ সকালে মণিমহেশের উচ্চ উপত্যকায় পৌঁছে দেখি প্রকৃতি সেখানে ফুলের বাগান সাজিয়ে অপেক্ষা করছেন। অজস্র ছোট ছোট ফুলের সমারোহে দিশেহারা হওয়ার উপক্রম। কোথা দিয়ে হাঁটব? দীর্ঘ ছমাসের ওপর এই উচ্চ উপত্যকা বরফে ঢেকে ছিল, এখন হাত ধরাধরি করে বসন্ত-গ্ৰীষ্মের আগমনে বরফের চাদরে সরে গিয়ে নন্দনকানন সৃষ্টি হয়েছে।

মণিমহেশ নামকরণের প্রসঙ্গে ভারমোরে শুনেছিলাম ভাদ্রমাসে রাধাষ্টমীর সময় সূর্যের আলো মণিমহেশ শিখরে এমনভাবে পড়ে যে দেখে মনে হয় যেন কৈলাশপতি মণি ধারণ করেছেন। আমার ধারণায়, মণিমহেশের শীর্ষদেশে শক্ত বরফের ওপর সূর্যের আলো সরাসরি পড়ে তা হিরের দ্যূতিতে বিচ্ছুরিত হয়ে থাকে। সরল পাহাড়ী মানুষের বিশ্বাসে তাই মহেশ্বর মণিভূষিত।

জন্মাষ্টমী থেকে রাধাষ্টমী মণিমহেশের পর্ব সময়। ভারমোরের গদ্দী উপজাতি সম্প্রদায় বিশেষভাবে এবং চাম্বাবাসী অন্যান্য ধর্মপ্রাণ মানুষেরা তাদের বিশ্বাস ও রীতি অনুসারে মণিমহেশক্ষেত্রে সমবেত হয়ে পূজার্চনা করে থাকেন। দীর্ঘ সময় ধরে এই প্রথা চলে আসছে। তাতে ঐ ক্ষেত্রের পরিবেশ দূষিত হয়নি। অনাড়ম্বর পাহাড়ী মানুষের সংখ্যা ছিল কম আর তারা পাহাড়ের মর্যাদা বুঝতেন, বিশেষ করে মণিমহেশ ক্ষেত্রের। হাডসার থেকে মণিমহেশ প্রাঙ্গণ পর্যন্ত আমাদের কোথাও মলিনতা চোখে পড়েনি। ওঠা-নামার পথে আর কোন যাত্রীও চোখে পড়েনি। আগে এ পথে বাইরের পর্যটক ছিল হাতেগোনা, কিন্তু গত বছরের মণিমহেশ পর্ব বা যাত্রা চলাকালীন তোলা একদিনের একটা ভিডিও দেখে মন খারাপ হয়ে গেল। কয়েকশো লোক, অধিকাংশই মনে হয় বহিরাগত, ভীড় জমিয়েছে। শুরুর দিকে থাকা ছোট গৌরীকুন্ড থেকে মণি কুন্ড পর্যন্ত সমগ্র উপত্যকা পদদলিত, অত্যাচরিত। চান ছাড়াও কাপড় কাচা-মেলা, রান্না-খাওয়া কিছুই বাদ নেই। মণি সরোবরের জলের মলিনরূপ মনকে নাড়া দেয় - এসব কি হচ্ছে?

ট্রেকরুট হিসেবে মণিমহেশের যাত্রাপথ আদৌ কষ্টের নয়, অথচ তৃপ্তিদায়ক। জুন বা অক্টোবরে যাওয়া ভালো। জুলাই-সেপ্টেম্বর বর্ষাকাল, মেঘ-বৃষ্টিতে যাত্রা পন্ড হতে পারে। জুনে দিন বড়, আবহাওয়া মনোরম, অক্টোবরে ঠান্ডা বেশি। আর পর্ব সময়ে নৈব নৈব চ (আমার মতে)। কথিত আছে মণিমহেশ দর্শনের পূর্বে ভারমোরে অবস্থিত ভারমানি মাতার মন্দিরে গিয়ে আশীর্বাদ নিতে হয়। আমরা অজ্ঞতার কারণে পরে সেখানে যাই। ভক্তিতে ঠিক নয়, ৪কিমি হেঁটে কিছুটা চড়াই ভেঙে গেছিলাম জল খেতে। চৌরাশী মন্দির চত্তরে শুনেছিলাম ওখানকার ঝর্ণার জল পান করে ভোলার নয়। ছোট ও খুব সাধারণ মন্দির, দড়জা বন্ধ ছিল, বিগ্ৰহ দর্শন সম্ভব ছিল না কিন্তু ধওলাধর শ্রেণীর সানুদেশে থাকা এই স্থানের দৃশ্যপট ছিল অসাধারণ। ওখান থেকে পুরো ভারমোরের জনপদ চোখের সামনে ছবির মতো ভাসছিল।আর জলের কথা যা শুনেছি তাও সত্যি। তৃষ্ণার্ত ছিলাম, সেই ঠান্ডা জল আকন্ঠ পান করে যে তৃপ্তি পেয়েছিলাম তা লিখে বোঝানোর নয়। এটুকুই বলতে পারি যে এখনো ভুলতে পারিনি।

এই যাত্রার কথা লিখতে বসে এতসব সুন্দর-সুন্দর ছবি ভেসে উঠছে যে লেখা বারবার থেমে যাচ্ছে, আমি শ্মৃতিপথে ফিরে গিয়ে আবার হাঁটছি আর পথের সৌন্দর্যে বিভোর হচ্ছি। শুধু হাঁটা আর দেখাই সব নয়, স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে ভাববিনিময় করে অনেক কিছু জানা যায়। মণিমহেশ নিয়ে গদ্দী উপজাতি সম্প্রদায়ের মধ্যে কিছু উপকথা চালু আছে। এছাড়া গদ্দীদের জীবনধারা, আরও কত কি! সব কিছুর শ্মৃতি ভীড় করে আসছে। লিখতে গেলে লেখা কোথায় থামবে জানিনা।

শেষ করি শেষপথের কয়েক টুকরো ছবির উল্লেখ করে -- প্রথমটা হাডসার থেকে সবে মণি মহেশের পথে হাঁটা শুরু করে। সঙ্কীর্ণ উপত্যকা, দুপাশে পাহাড়, সামনে দেখি ঘন নাতিশীতোষ্ণ বনের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে এক শুভ্রবসনা নৃত্যপরা প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর সুঠাম তরুণী।
ঢালুপথে সে নামছে ওপর থেকে নীচে, আমি উল্টোপথে। সেই তরুণী মণিমহেশ গঙ্গাকে আমার প্রথম দর্শন। তার রূপের জাদুতে আমি তৎক্ষণাৎ মন্ত্রমুগ্ধ, আর সে মুগ্ধতা সারাটা পথেই ছিল। দ্বিতীয়টা ধানছো পেরিয়ে চড়াই ভাঙার পথে। দেখি নদী আরও তন্বী, শীর্ণাঙ্গি ও উদ্দাম। স্থানবিশেষে অত্যন্ত খরস্রোতা আর চোখে পড়ে কিছু ছোট ও মাঝারি মাপের দৃষ্টিনন্দন জলপ্রপাত যা তার লাফিয়ে নামার চিহ্ন রেখেছে। ধানছোর আগে ও পরে নদী ভিন্নরূপে প্রতীয়মান আর তা নিঃসন্দেহে মনে রাখার মত। তৃতীয়টা মণিমহেশ কুন্ডে পৌঁছে পাশের একটা পাহাড়ে কিছুটা উঠেছিলাম, চারপাশটা ভালো করে দেখতে। সেই দেখার ছবিটা মনে ভাসে কারণ সেটা মনে রাখার মত ছিল। চারপাশে সপারিষদ কৈলাশনাথ তখনও বেশকিছুটা হিমাবৃত আর তার পায়ের কাছে হিমশীতল সরোবর, কিছুটা পাশে আবার ফুলের মেলা—দেখে চোখ ফেরানো দায়। সমস্ত উপত্যকাটা সুষ্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল যা কুন্ডের পাশে দাঁড়িয়ে দেখা সম্ভব হয় নি।

মণিমহেশ যাত্রা এইভাবেই শেষ হয়েছিল। জুন মাসের শেষদিকে পাহাড়ে কটাদিন ভালোই কেটেছিলো। ফেলে আসা দিনগুলো আর ফিরে আসে না। ফিরে আসে তার শ্মৃতি, যা মাঝেমধ্যে মনকে নাড়া দেয়; স্বপ্ন দেখায়।

Comments

Popular posts from this blog

রিতা বসু

আমার জীবনের প্রথম এডভেঞ্চার : আজ সরস্বতীপূজো। আজকের দিনেই আমাদের সবারই বোধহয় হাতেখড়ি হয়। স্লেট পেনসিলে মাতৃভাষা লিখনের প্রথম শিক্ষা। তাই, সৌমিত্রর আবেদনে সাড়া দিয়ে আজকের দিনটিই বেছে নিলাম আমার জীবনের প্রথম এডভেঞ্চার-এর স্মৃতি রোমন্থনের জন্য।

কানাইলাল জানা

পুরো ভ্রমণ কথা পড়তে ভ্রমণকারীর নাম -এর ওপর ক্লিক করুন ।। হোম পেজ-এ যেত এখানে ক্লিক করুন audio testing ভ্রমণকারীর কণ্ঠে ভ্রমণ কথা  এই দেখা সিউড়ি থাকাকালীন বীরভূমের যে সব গ্রাম দেখেছি, তার মধ্যে আকর্ষণীয় নাম বক্রেশ্বরের পথে 'ধান্যকুড়িয়া। রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী অশোকতরু বন্দ্যোপাধ্যায়ের গ্রাম, যার অনেকটাই এখন ময়ূরাক্ষীর রোষানলে।