Skip to main content

বিস্ময় রায়

audio testing
ভ্রমণকারীর কণ্ঠে ভ্রমণ কথা। 
হনুমান টিব্বার রাত :

ধিকি ধিকি জ্বলছে কাঠের আগুন। ঝকঝকে বাতাসে মুরগি সেঁকার ধোঁয়াটে সুবাস। ওই উত্তাপ ঘিরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আমরা জনা পনের। নানা সাইজের পাথরে গোল হয়ে বসে, গল্প টুকটাক। পাশদিয়ে বিপাশার সগর্জন উচ্ছ্বাস! ধবধবে সফেদ, ধূসর, খয়েরি, পাটকিলে, সবজেটে, ছিটেদার হরেক রঙের পাথর টেনে নিয়ে পালিশ করতে করতে পাগলীপারা সে চলেছে অধঃপতনের নেশায়। তার প্রায় কোল ঘেঁষেই আমাদের ক্যাম্প। না'হাজার ফুট উচ্চতার আশেপাশে!

ধুনি জ্বালার আগে কার্ড জোগার করতে লাগে। তাই গোড়ার গপ্পটি আগে বলি।

মানালি থেকে হিমালায়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউটের গাইডেন্স-এ আমরা কয়জন শখের ট্রেকার চলেছি হনুমান টিব্বার নিচে বিয়াসকুণ্ড, হিমাচলে। অচেনা দল, এলোমেলোভাবে আপেল ক্ষেতের ভিতর দিয়ে নালা ডিঙিয়ে ছবির মত সোলাঙ উপত্যকার মখমল সবুজ বুগিয়াল পার হয়ে টানা হাটছি। দুদিন হেঁটে কনকনে ছুরির মত বরফ-শীতল ঝর্ণা র‍্যাপেলিং করে পেরিয়ে, এই বকর থাচে জনহীন গিরিশিরায় ছাউনি ফেলেছি। কনকনে ঠান্ডা, হা ক্লান্ত শরীর, নিজের নিজের ক্ষুদে তাঁবুতে স্লিপিং ব্যাগে সেঁধোবার আগে এই গোলাড্ডা। হিমাচলী বাবুর্চি তখনো গরম গরম নিরামিষ রাজমা-চাওল আর হালুয়া মেকশিফ্ট চুলহা থেকে নামাতে পারে নি।
বাঙালি আমরা মাত্র দুজন। দুজন মারাঠি। তিনজন মলয়ালি। আর দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে বেড়াতে আসা একটি পোড়োর দল। তাদের পূর্বপুরুষরা নাকি ভারতীয়। তাই প্র-প্র-প্রপিতামহর দেশে ঘুরতে এসেছে শীতের ছুটিতে। 22/23 এর পাঁচটি মেয়ে আর তিনটে ছেলে। এমন জনবিরল খোলা স্পটে এতজন সুন্দরী একসাথে! ইমপ্রেস করার প্রবল ইচ্ছা দাবিয়ে রাখা গেল না। যেহেতু ওদের মাতৃভাষাটায় মোটামুটি কাজ চালাতে পারি, সেই সুবিধার ষোলআনা সদ্ব্যবহার করতেই হবে! কাজেই এমন পাহাড়ি আঁধারে নিবু নিবু আগুনের ধারে ইয়েতির গল্প ফেঁদে বসলুম। Abominable Snowman এর ছায়াময় সব ভয়াল কাল্পনিক ইতিহাস!! সুন্দরী যুবতীরা তো বটেই, বাকিরাও পিছনে মাঝে মাঝে তাকিয়েই আরও ঘেঁষে আসছে।

আফ্রিকান সুন্দরীরা নাকি কোনদিন ইয়েতির কথা শোনেননি। ফলে তাদের অনেক quiry. আমি সবজান্তা নই। ওখানে কেউ চ্যালেঞ্জ করারও নেই। ছোটবেলায় পড়া অ্যাডভেঞ্চারের সঙ্গে আপন মনের মাধুরী ঢালাও মিশিয়ে যা ছাড়লাম তাতে নিজেরই বুক ছমছম করছে! বাকিরা তো ফ্যাকাশে মুখে কোনমতে ডিনার সেরেই সো--জা স্লিপিং ব্যাগের ভিতর। আমিও নাক-মুখ ঢেকে টেন্ট জিপার টেনে দিলাম। বাইরের তুমুল শীত আর সারাদিন পাহাড় ভাঙার শ্রমে মিনিটের কাটা একপাক দিতে না দিতেই ঘুমিয়ে কাদা।

আচ্ছন্ন অবস্থায় মৃদু অস্বস্তি টের পাচ্ছিলাম। হাত ঘড়ি রুকস্যাকের ভিতর। মোবাইল নি:সাড় বলে তাকেও ঘুম পাড়িয়েছি। কত রাত জানি না। সেই কৈশোরের বিদ্যাপীঠের হোস্টেলে প্রতিরাতে একবার না একবার হালকা হতে বারান্দা পার হয়ে টয়লেটে যেতে হতো। অভ্যাস যাবে কোথায়? বেরোতেই হল। একটুও মন চাইছিল না যদিও। চরম ঠান্ডায় কাঠ হয়ে যাচ্ছে দেহ। হুডি জ্যাকেট চাপিয়ে বেরোলেও নিচে তো শুধুমাত্র ট্রাকসুট-এর লোয়ার। সব শুদ্ধ জমে না যায়! কোনমতে নদীর কিনারে গিয়ে হালকা হতে হতে সামনে তাকিয়ে অভিভূত! বুদ্ধ পূর্ণিমার দিন তিনেক পরের রাত। কৃষ্ণা তৃতীয়ার চকচকে রাগবি চাঁদ নিথর প্রান্তরে নিশ্চুপে ঢেলে চলেছে টন টন গলা রুপো। বিপাশার চঞ্চলা স্রোতে তাকিয়ে অনুভব করলাম 'তরলিত চন্দ্রিকা' কাকে বলে। মূঢ়ের মত শেষ রাতের অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছি। জনশূন্য প্রান্তরে। জীপারটাও লাগাতে ভুলে গেছলুম খানিকক্ষণ! সামনে দুপাশে সারসার খাড়া অনামী সব শৃঙ্গ। পাথুরে, কিন্তু রাতের হিম পরে তাদের সবার চূড়োর চকচকে বরফের হেলমেট। আর জোরদার জ্যোৎস্নায় সব চকচক। গায়ে রুপো মেখে দূরে দলা পাকিয়ে বার্চ, দেবদারু, পাইনের ভিড়। আর তাদের মাথা ছাড়িয়ে অনেক উঁচুতে গলা রুপোর টোপর পরা কারাকোরাম-এর রাত-চূড়োর দল। পুরো ৩৬০ ডিগ্রী জুড়েই।
আমাদের ক্যাম্প ছিল শৃঙ্গ ঘেরা বাটির মতো একটা জায়গায়। দেখতে দেখতে নেশার ঘোর লেগে যাচ্ছিল। সেই রূপ অবর্ণনীয়। কোন লেন্সেই ধরা দেবে না। ওরা যেন ষড় করে সবার চোখ এড়িয়ে কেবল আমার জন্য ঘোমটা খুলে চারদিকে ভিড় করেছিল। সেই রাতে নিঃশব্দে অফার করেছিল সেই অলৌকিক সৌন্দর্য শুধু দু-চোখ ভরে পান করার জন্য। খানিক পর ধীরে ধীরে যখন নিজের তাঁবুতে ঢুকতে যাব, আচমকাই চোখে পড়ল সেই নিভে যাওয়া ক্যাম্প ফায়ার-এর পাশদিয়ে ঘোলাটে অন্ধকারে কি যেন মিলিয়ে যাচ্ছে --- রোমশ, ধূসর, আবছা মতো! কিছু ঠাহর করার আগেই -- নেই! কী ওটা! আর দেখা গেলো না। তীব্রতর শীতে গোটা শরীর কেঁপে উঠল। সটান ব্যাগে ঢুকে পড়লাম। 

পরদিন সকালে অন্যদের মুখে শুনেছি, বিপাশার উৎস সন্ধানে এগোতে এগোতে সেই রাতে, ভয়ে ছেলেমেয়েরা কেউই তাবু ছেড়ে বেরোয়নি মোটে। অনেকেই সারা রাতে বারবার শুনেছে ভারী এক থপথপে পদশব্দ!

কী ভীতু সবকটা!

Comments

Popular posts from this blog

রিতা বসু

আমার জীবনের প্রথম এডভেঞ্চার : আজ সরস্বতীপূজো। আজকের দিনেই আমাদের সবারই বোধহয় হাতেখড়ি হয়। স্লেট পেনসিলে মাতৃভাষা লিখনের প্রথম শিক্ষা। তাই, সৌমিত্রর আবেদনে সাড়া দিয়ে আজকের দিনটিই বেছে নিলাম আমার জীবনের প্রথম এডভেঞ্চার-এর স্মৃতি রোমন্থনের জন্য।

অলক কুমার গাঙ্গুলী

খাজিয়ার থেকে মণিমহেশ : এক তারুণ্যভরা সৌন্দর্য্য। মাঝেমধ্যে আকস্মিকভাবে বিনা চেষ্টায় আমার সময়-পর্যটনের (time travel এর) সুযোগ ঘটে। যেসব মাধ্যম সময় যন্ত্রের (time machine-এর)কাজ করে সেগুলো বেশ মজার। হয়ত কোন জায়গার ছবি বা কুড়োন কোন পাথরখন্ড না হয় কোন লেখার পাতা। গত সপ্তাহের কথা বলি, কিছু দরকারী কাগজ খুঁজতে গিয়ে অন্য একটা বিচ্ছিন্ন পাতা নজরে এল। কাজের কিনা বুঝতে সবে দুলাইনে চোখ বুলিয়েছি অমনি দেখি আমি আর পড়ার ঘরে নেই; পৌঁছে গেছি ২৫বছর আগের দেখা হিমাচলের খাজিয়ারে। এরপর চোখের সামনে কত ছবি, কত সুখশ্মৃতির আনাগোনা। তারপর হঠাৎ কারো ডাকে বাস্তবে ফিরে আসা। সময় বিশেষে এরকমই সব ভ্রমণ হয় যাতে আমার ভূমিকা আছে, নিয়ন্ত্রণ নেই। এক পাতার ছোট্ট লেখা---খাজিয়ারের প্রাঙ্গণে কিছু সময় বিশ্রাম নিয়েছিলাম, এটা সেই সময়ের কল্পনা। ঐ ভ্রমণের কিছু ছবি ছিল, লেখা কিছু ছিল না। এতদিন পরে এটা পাওয়ার পর ঐ যাত্রার মূল আকর্ষণ কেন্দ্রগুলো সম্বন্ধে কিছু লিখে রাখার ইচ্ছায় এই প্রয়াস। এখন তো বেড়ানো বন্ধ হয়ে গেছে, আর লিখতেও আসুবিধা হয়--তাই ফোনের পাতায় লেখার চেষ্টা করে দেখছি, পারি কিনা। বাংলায় লেখার

কানাইলাল জানা

পুরো ভ্রমণ কথা পড়তে ভ্রমণকারীর নাম -এর ওপর ক্লিক করুন ।। হোম পেজ-এ যেত এখানে ক্লিক করুন audio testing ভ্রমণকারীর কণ্ঠে ভ্রমণ কথা  এই দেখা সিউড়ি থাকাকালীন বীরভূমের যে সব গ্রাম দেখেছি, তার মধ্যে আকর্ষণীয় নাম বক্রেশ্বরের পথে 'ধান্যকুড়িয়া। রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী অশোকতরু বন্দ্যোপাধ্যায়ের গ্রাম, যার অনেকটাই এখন ময়ূরাক্ষীর রোষানলে।